টোলের বাড়ীর ঠাকুর

বীরেশ্বর ঠাকুরের ৬ষ্ঠ পুত্র সদাশিব ন্যায়ভূষণ ও তাঁহার ধারার পরিচয়।

[ইঁহারা টোলের বাড়ীর ঠাকুর বলিয়া অভিহিত]


  1. সদাশিব ন্যায়ভূষণ

  2. বীরেশ্বর ন্যায়ালঙ্কারের পুত্র। ইনি পিতার উপযুক্ত সন্তান ব্রহ্মনিষ্ঠার নিরত ও বড় সরল প্রকৃতি ছিলেন। তন্ত্রশাস্ত্রে বড় পণ্ডিত হইয়াছিলেন। ষটকর্ম্মদীপিকার একটি সরল পদ্ধতি রচনা করেন। কিন্তু এক্ষণে উহা আর সম্পূর্ণ পাওয়া যায় না দু-একখানি মাত্র পাতা পাওয়া যায়।
  3. হরিরাম তর্কবাগীশ

  4. সদাশিব ঠাকুরের জ্যেষ্ঠ পুত্র। ইনি একজন নৈয়ায়িক ও প্রসিদ্ধ তান্ত্রিক ছিলেন। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র ইঁহাকে সম্মানপুরঃসর বড়া কুমারডেঙ্গী ও ছেলেডেঙ্গী গ্রামে দুশত বিঘা ব্রহ্মত্রা ভূমি দান করেন। বংশধরেরা এখনও তাহা ভোগ করিতেছেন। বাঁশবেড়িয়ার হংসেশ্বরী ও তাঁহার মন্দির তর্কবাগীশের তন্ত্রবিদ্যার প্রকৃষ্ট পরিচয়। এই মূর্ত্তি বাঁশবেড়িয়ার রাজা নৃসিংহদেব রায়ের স্বপ্নদৃষ্ট মূর্ত্তি। স্বপ্নান্তে রাজা উহা অঙ্কিত করিয়া মূর্ত্তিপরিচয়ের জন্য পণ্ডিতসমাজে প্রেরণ করেন কিন্তু কেহ বলিতে পারেন নাই। ক্রমে উহা ভাটপাড়ায় আসে ও তর্কবাগীশ তন্ত্রোক্ত হংসেশ্বরীদেবীর ধ্যানের সহিত মিলাইয়া উহার নামকরণ করিয়া দেন ও দেবীর যন্ত্র আঁকিয়া দেন। হংসেশ্বরীর মন্দির সেই যন্ত্রাকৃতি। রাজা বড় সন্তুষ্ট হন ও মেদনমোল্লা পরগণায় দুইশত বিঘা নিষ্কর ভূমি দান করেন। বংশধরেরা এখনও ভোগ করিতেছেন। এইরূপে হংসেশ্বরীর মূর্ত্তি ও মন্দির ভাটপাড়ার একটি কীর্ত্তি কিন্তু একথা এই সবেমাত্র লিপিবদ্ধ হইল। হংসেশ্বরী সম্বন্ধে ইতিহাস বাহির হইয়াছে তাহাতে এ কথাটি নাই। ভরসা করি বাঁশবেড়িয়ার কুমার মুণীন্দ্রদেব রায় মহাশয় তাঁহার প্রতিষ্ঠিত হুগলী জেলার ঐতিহাসিক সমিতিতে (Hooghly District Historical Association) এইবার ইহা লিপিবদ্ধ করিবেন। স্বয়ংভবার ও হংসেশ্বরীর মন্দিরের শিলালিপির শ্লোকদ্বয়ও তর্কবাগীশেরই রচিত ও যন্ত্রানুসারে মন্দিরনির্ম্মাণও তাঁহারই তত্বাবধানে হয় বলিয়া শুনা যায়। কুমার বাহাদুরের পূর্ব্বপিতামহ ও তর্কবাগীশ মহাশয় এই সূত্রে পরস্পর-পরস্পরের প্রতি বড়ই আকৃষ্ট ছিলেন। সন ১২০৪ সালে এই বংশেরই বিশিষ্ট সৌভাগ্যবান্‌ পুরুষ রামকান্ত সার্ব্বভৌম যখন মাদ্রালে দীর্ঘিকা প্রতিষ্ঠা করেন তখন সমাগত নানাস্থানের পণ্ডিতগণের সহিত তর্কবাগীশের এক বিচার হয় ও তাহাতে তিনি যশস্বী হয়েন। ইঁহার পুত্র ও ভ্রাতুষ্পুত্রদিগের মধ্যে এক সময়ে ৫/৬ খানি চতুষ্পাঠী থাকে ও তথায় নানাশাস্ত্রের অধ্যাপনা চলিত তাই তখন হইতে ইঁহাদের “টোলের বাড়ীর ঠাকুর” এই নাম চলিয়া আসিতেছে। সন ১২০৯ সালে ৭৪ বর্ষ বয়সে ইঁহার গঙ্গালাভ হয়। ১১৯০ সালে ইঁহার হস্তলিখিত একখানি পুস্তক আজও দেখিতে পাওয়া যায়।
  5. রামদেব বাচস্পতি

  6. হরিরামের জ্যেষ্ঠ পুত্র। ইনিও পিতার যোগ্য সন্তান। স্বজন প্রতিপালক ও সুপণ্ডিত ছিলেন।
  7. মুকুন্দদেব ঠাকুর

  8. রামদেবের জ্যেষ্ঠ পুত্র। বংশোচিতগুণসম্পন্ন ছিলেন।
  9. রামপ্রসন্ন ঠাকুর

  10. মুকুন্দদেবের পুত্র। বংশোচিতগুণসম্পন্ন ছিলেন।
  11. চণ্ডীচরণ বিদ্যারত্ন

  12. রামপ্রসন্নের পুত্র। এমন দেশহিতৈষী পুরুষ দেখা যায় না। আজ এই যে ভাটপাড়ার পোষ্ট অফিস ও ইংরাজী স্কুল ভাটপাড়ার উপকার করিতেছে, ইহা ঐ চণ্ডীচরণেরই একান্ত যত্ন ও পরিশ্রমের ফল। এ সম্বন্ধে ভাটপাড়া তাঁহার কাছে চিরদিন ঋণী থাকিবে। এইতো দেশের কাজ তাহার উপর তিনি একজন কঠোর নিষ্ঠাবান্ সদাচারী ব্রাহ্মণ পণ্ডিত ছিলেন। এবংশে যেমন হওয়া চাই তেমনি শুদ্ধাচারী গুরু ছিলেন। এই প্রিয়মধুরভাষী কর্ত্তব্যনিষ্ঠ মহাজনের অভাবে গ্রামের বিশেষ ক্ষতি হইয়াছে।
  13. রাজকুমার কাব্যতীর্থ

  14. চণ্ডীচরণের পুত্র। পিতার জীবতকালেই ইঁহার অকালে দেহ যায়। ইনি একজন নির্ভীক পুরুষ ছিলেন। কাব্যোপাধিতে উত্তীর্ণ হইয়া গবর্ণমেন্টের স্কুলে শিক্ষকতা করিতেন। ইঁহার অকালমৃত্যুতে ইঁহার বৃদ্ধ পিতা বড়ই শোকার্ত্ত হইয়াছিলেন।
  15. মাধবচন্দ্র ঠাকুর

  16. রামদেবের ২য় পুত্র। বংশোচিতগুণসম্পন্ন ছিলেন।
  17. রামতরণ ঠাকুর (তর্কালঙ্কার)

  18. মাধবঠাকুরের জ্যেষ্ঠ পুত্র। বংশোচিতগুণসম্পন্ন ছিলেন। পুত্রে ইঁহার পুণ্য প্রকাশ।
  19. কালীনাথ ঠাকুর (বিদ্যারত্ন)

  20. মাধব ঠাকুরের কনিষ্ঠ পুত্র। বংশোচিতগুণসম্পন্ন ছিলেন। পুত্রে ইঁহার পুণ্য প্রকাশ।
  21. যাদবচন্দ্র ঠাকুর

  22. রামদেবের ৩য় পুত্র। বংশোচিতগুণসম্পন্ন ছিলেন।
  23. গোবিন্দচন্দ্র ঠাকুর

  24. যাদব ঠাকুরের জ্যেষ্ঠ পুত্র। বংশোচিতগুণসম্পন্ন ছিলেন।
  25. রাখালচন্দ্র বিদ্যারত্ন

  26. গোবিন্দঠাকুরের পুত্র। ইনি একজন সংস্কৃতে বেশ ব্যুৎপন্ন ও বড়ই শান্ত প্রকৃতির লোক ছিলেন। বহুদিন হুগলি জেলাস্থ বালীগ্রামে সম্ভ্রমের সহিত বাস করিয়া শেষ বয়সে কাশীবাসী হন ও শিবক্ষেত্রেই দেহ রাখেন।
  27. উপেন্দ্রনাথ ঠাকুর

  28. রাখালঠাকুরের পুত্র। পিতার জীবিতকাবেই অকালেই ৺গঙ্গালাভ করেন। পুত্রেই ইঁহার পুণ্য প্রকাশ।
  29. রঘুমণি বিদ্যাভূষণ

  30. রামদেবের ৪র্থ পুত্র। সকল শাস্ত্রে অধিকারী থাকিয়া তন্ত্র ও জ্যোতিষে বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। ইনি একজন বিখ্যাত ঋষিকল্প ব্রহ্মনিষ্ঠ সন্তোষশীল সুব্রাহ্মণ। জ্ঞানে কখনও মিথ্যা কথা বলেন নাই। তাঁহার চান্দ্রায়ণ করাইবার সময় সংকল্পবাক্যে “জ্ঞানকৃত পাপক্ষয় জন্য” এই শব্দ উচ্চারণ করিতে তিনি দ্বিধা বোধ করিয়াছিলেন। এমনিই তিনি নিষ্পাপ ছিলেন বলিয়া মনে একটা তেজ ছিল। এ তেজ তাঁহার মত নিষ্পাপীরই শোভা পাইয়াছিল। ব্রহ্মর্ষিকল্প সে সব মনুষ্য বংশের গৌরব বৃদ্ধি করিয়া গিয়াছেন।
  31. শিবচন্দ্র সার্ব্বভৌম (মহামহোপাধ্যায়)

  32. রঘুমণি বিদ্যাভূষণের দ্বিতীয় পুত্র। ইনি একজন দেশবিখ্যাত নৈয়ায়িক ছিলেন। এই পণ্ডিতশ্রেষ্ট ন্যায়শাস্ত্রের অধ্যাপনায় বিপুল ছাত্রসম্পদে বঙ্গে অদ্বিতীয় যশস্বী হইয়া ছিলেন। তিনি প্রথমে বাটীতে কএক বৎসর তপঃসাধনার ন্যায় অধ্যাপনার সাধনা করিয়া যখন প্রসিদ্ধি লাভ করিলেন তখন সুপ্রসিদ্ধ গুণাদরকারী মহেশচন্দ্র ন্যায়রত্নের অনুরোধে মূলাজোড় সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষরূপে প্রতিষ্ঠিত হন ও তথায় শেষ জীবন পর্য্যন্ত অধ্যাপনা করেন। বঙ্গে এরূপ জেলা নাই যথায় তাঁহার কৃতবিদ্য ছাত্র অধ্যাপনা করিতেছেন না। সপ্তম এডওয়ার্ডের রাজ্যকালে গবর্ণমেন্ট হইতে তিনি মহামহোপাধ্যায় উপাধি লাভ করেন। তাঁহার অনেক ছাত্রও মহামহোপাধ্যায় হইয়াছেন। কত ছাত্রই যে পড়াইয়াছেন তাহার ইয়ত্তা নাই। ন্যায়শাস্ত্রের তিনি একজন বড় রকমের প্রচারক ছিলেন। তাঁহার অভাবে বঙ্গে ন্যায়প্রচারে বিশেষ ব্যাঘাত ঘটিয়াছে। “কুসুমাঞ্জলীর” এক নবীন টীকা ইনি লেখেন ও উহা বিদ্যোদয় মাসিক পত্রিকায় বাহির হয়। দার্শনিকতার সঙ্গে সঙ্গে ইঁহার কবিত্ব প্রায় আজন্মসিদ্ধ। ১৩ বৎসর বয়সে ‘পাণ্ডবচরিত’ নামক অপূর্ব্ব এক সংস্কৃত নাটক রচনা করেন। খণ্ডকাব্য লিখনেও ইনি সিদ্ধহস্ত ছিলেন, কতই যে সংস্কৃত শ্লোক রচনা করিয়াছিলেন তাহার সংখ্যা নাই, সে সকল রাখিয়া দিবার যত্ন থাকিলে একখানি বড় গ্রন্থ হইতে পারিত। পাণ্ডিত্যেতো এই এমন অত্যুজ্বল, স্বভাবেও আবার তেমনি কোমল কান্ত, শিব তো শিব, লোকের দুঃখে গলিয়া পড়িতেন। কত দুর্গতের ঋণজাল কাটিয়া গিয়াছেন, কত লোকের বাস্তু রক্ষা করিয়া গিয়াছেন, কত লোককে কত রকমে উপকার করিয়া গিয়াছেন। তিনি গ্রামের অনেকের একটা ভরসাস্থল ছিলেন। ৭২ বৎসর বয়সে ইঁহার গঙ্গালাভ হয়। তিনি আরও কিছুদিন থাকিলে গ্রামের শ্রী ও সাহস অক্ষুন্ন থাকিত। ইনি এই বংশের রত্ন মহামহোপাধ্যায় রাখালদাস ন্যায়রত্নের ছাত্র ছিলেন। যোগ্য অধ্যাপকের যোগ্য ছাত্র। \footnote{এনার কৃতী ছাত্ররা হলেন মেদিনীপুরের কাঁথির তারাপ্রসাদ ন্যায়রত্ন, ময়মনসিংহের কালীকৃষ্ণ তর্কতীর্থ, ফরিদপুরের চন্দ্রকিশোর তর্কতীর্থ, ফরিদপুরের চন্দ্রকিশোর সিদ্ধান্তবাগীশ, মাণিকগঞ্জের/রহড়ার তারানাথ ন্যায়-তর্ক-ব্যাকরণতীর্থ...।}
  33. জয়রাম ন্যায়ভূষণ

  34. রামদেব বাচস্পতির ষষ্ঠ পুত্র। এই এক পুণ্যশ্লোক মহাপুরুষ বংশ উজ্জ্বল করিয়া গিয়াছেন। ইনি ইঁহার খুল্লতাতপুত্র প্রসিদ্ধ ভৈরববিদ্যাসাগরের নিকট ন্যায়শাস্ত্র অধ্যয়ণ করেন ও ন্যায়ে কৃতী হন কিন্তু গ্রামে তখন ব্যাকরণ পড়াইবার লোক বিরল হয়ে যাওয়ায় এই ফলী নৈয়ায়িক স্বজনগণের অনুরোধে ব্যাকরণের চতুষ্পাঠী করেন ও তাহা পড়াইতে থাকেন। কি প্রতিভা! কি মেধা! সমগ্র অমরকোশ স্মৃতিপথে। ব্যাকরণাধ্যাপনায় একটা নবযুগ প্রবর্ত্তিত হইল। শুধু কি ব্যাকরণ, সঙ্গে সঙ্গে কাব্যচর্চ্চাও বেশ সজোরে চলিতে লাগিল। ন্যায়ভূষণ মহাশয় কাব্যের মধ্যে নিজে পড়িয়াছিলেন ভট্টি ও নৈষধ। তখনকারকালে “রঘুরপি কাব্যং তদপিচ পাঠ্যং” কালিদাসের উপর এই শ্লেষোক্তি চলিতেছে। ন্যায়ভূষণ মহাশয় কিন্তু কালিদাস ও অন্যান্য কবিদিগকে চিনিয়াছিলেন। সকল কাব্যেরই সমধিক পাঠনা আরম্ভ হইল। তিনি স্বপ্রতিভাবলেই সকল কাব্যই আয়ত্ত করিয়া ফেলিয়াছিলেন। কাব্য পাঠ এই সময় হইতেই ভাটপাড়ায় চলিত হয়। তিনি ভারবির একখানি টীকা প্রস্তুত করেন কিন্তু দুঃখের বিষয় উহা নষ্ট হইয়া গিয়াছে। তাঁহার কাব্যাধিকার দেশময় রাষ্ট্র হওয়ায় সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপক প্রেমচাঁদ তর্কবাগীশ নৈষধের টীকা প্রণয়ন করিয়া ভাটপাড়ায় আসিয়া তাঁহাকে উহা দেখান ও স্থানে-স্থানে তৎকৃত পরিবর্ত্তন ও পরিবর্দ্ধন সাদরে গ্রহণ করেন। ৫০ বৎসরকাল এই মহাপুরুষ অধ্যাপনা করেন ও দেশে-বিদেশে কত ছাত্রই যে পড়াইয়া গিয়াছেন তাহার সংখ্যা নাই। রাখালদাস ন্যায়রত্ন প্রভৃতি মহারথীরা ইঁহার ছাত্র। ইনি যেমন অসাধারণ বিদ্বান্‌ ছিলেন তেমনি অমায়িক ছিলেন, যেন কলিযুগের মনুষ্য নহেন। বিষয় কর্ম্ম এতই কম বুঝিতেন যে শুনিলে হাঁসি পায়। এক সময়ে তাঁহার এক প্রজাকে তিনি ৫০/- টাকা কর্জ্জ দেন, টাকা দিয়া বলেন: “বাপু আমি তোমায় টাকা কর্জ্জ দিলাম বটে, ইহার সুদ কিন্তু আমি দিতে পারিব না।” ব্যাপারটা দেখুন, এ কি এ যুগের মানুষ! ইনি অনেক চলিত কথার সাধুভাষা বাহির করিয়া গিয়াছেন, তন্মধ্যে বাস্ক’র ‘বসুকোষ’ শব্দ লোকের স্মরণে রহিয়াছে। সন ১২৮৭ সালে ৮২ বর্ষ বয়সে ইঁহার গঙ্গালাভ হয়। তাঁহার গঙ্গাযাত্রার সময় প্রায় গ্রামশুদ্ধ সমস্ত লোক অনুগমন করিয়াছিল। ঠিকৃ যেন বীরেশ্বর ন্যায়ালঙ্কারের সেই গঙ্গাযাত্রা। ইঁহার ধারা দৌহিত্রগত হইয়াছে।
  35. রামমাণিক্য তর্কভূষণ (ওরফে বেচুঠাকুর)

  36. হরিরাম তর্কবাগীশের কনিষ্ঠ পুত্র। ইনি একজন খ্যাতিমান্ নৈয়ায়িক ছিলেন। অধ্যাপনার ব্যয়নির্ব্বাহ জন্য তিনি কৃষ্ণনগর রাজসংসার হইতে বরিজহাটী পরগণায় একশত বিঘা নিষ্কর ভূমি পান। এক্ষণে ঐ সম্পত্তি ১১০২ নম্বর তালুক হইয়া বংশধরদের ভোগে আসিতেছে।
  37. নিমাই তর্কপঞ্চানন (ওরফে নিমানন্দ)

  38. রামমাণিক্যের জ্যেষ্ঠ পুত্র। ইনি স্বীয় পিতামহ ভ্রাতুষ্পুত্র প্রসিদ্ধ ভৈরবচন্দ্র বিদ্যাসাগরের নিকট ন্যায়শাস্ত্র অধ্যয়ন করিয়া উজ্জ্বল নৈয়ায়িক হন। বহু ছাত্রকে অন্ন দিয়া অধ্যাপনা করেন। তাঁহার ছাত্রগণের মধ্যে গুপ্তিপাড়ার অদ্বিতীয় নৈয়ায়িক গঙ্গাধরবিদ্যারত্ন উল্লেখযোগ্য। ইনি ২৭ বর্ষ বয়সে পড়াইতে আরম্ভ করেন ও ১৩ বৎসরকাল কঠোর তপস্যার ন্যায় দিবারাত্রি অনন্যকর্ম্মা হইয়া ন্যায়শাস্ত্রাধ্যাপনারূপ সাধনা করিয়া গিয়াছেন। ভাটপাড়ার দুর্ভাগ্য ৪০ বৎসর বয়সে তাঁহার মত রত্নকে হারাইতে হইয়াছে। তিনি অধ্যাপনার ব্যয়-নির্ব্বাহ জন্য পৈতৃক সম্পত্তি পর্য্যন্ত নষ্ট করিতে কুন্ঠিত হন নাই। তাঁহার সম্বন্ধে একটি তাৎকালিক অপূর্ব্ব সমাজচিত্রের কথা বলি। বঙ্গের কবিশ্রেষ্ঠ হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের পিতা কৈলাশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁহার মন্ত্রশিষ্য ছিলেন ও গুরুদেবের ছাত্রপোষণের বিশেষ সাহায্য করিতেন। তর্কপঞ্চানন মহাশয় এক সময় তাঁহার নিকট উপস্থিত হইলে বন্দ্যোপাধ্যায় কথাপ্রসঙ্গে বলেন: “গুরুবেদ! সংস্কৃত কলেজে নৈয়ায়িক অধ্যাপকের পদে একজন ভাল লোক লইবার ব্যবস্থা হইতেছে শুনিয়া আমি ডিরেক্টর সাহেবের কাছে আপনার নাম করিয়াছি, ইহাতে বিনা ব্যয়ে বহুছাত্র পড়ান ঘটিবে এবং মাসিক ৫০/- টাকা বৃত্তিও পাওয়া যাইবে, এক্ষণে আপনার সম্মতি পাইলেই স্থির করিয়া ফেলি।” বন্দ্যোপাধ্যায় জানিতেন না যে তাঁহার গুরুদেব ইহাতে ক্ষুব্ধ হইবেন। তর্কপঞ্চানন এই কথা শুনিয়া ক্ষোভে ও দুঃখে কাঁদিয়া ফেলিলেন, বলিলেন, “কৈলাশ তুমি আমাকে গরীব গুরু বুঝিয়া চাকুরীর প্রলোভন দেখাইতেছ, তোমার কষ্ট হইলে আমার ছাত্রপোষণের সাহায্য তুমি করিও না। আমি চলিলাম।” ব্যাপার যে এমন দাঁড়াইবে কে জানিত, বন্দ্যোপাধ্যায় তৎক্ষণাৎ করজোড়ে তাঁহার নিকট ক্ষমা চাহিলেন, তাঁহার পত্নী আসিয়া গললগ্নীকৃতবাসে গুরুদেবকে প্রসন্ন করিলেন, বলিলেন, “ঠাকুর, উনি জানিতেন না, যে চাকরী আপনার কাছে এত ক্ষোভের কারণ। ক্ষমা করুন।” গুরুদেব প্রসন্ন হইলেন। আমরি কি কালই ছিল! আবার একবার বলি হায় অতীত তুমি কোথায় গিয়াছ!
  39. মৃত্যুঞ্জয় শিরোমণি

  40. নিমাইচন্দ্রের জ্যেষ্ঠ পুত্র, ইনি একজন স্মার্ত্ত পণ্ডিত ছিলেন। অনেক ছাত্রকে অন্ন দিয়া অধ্যাপনা করিতেন। তাঁহার কৃতীছাত্র এখনও দেখা যায়। এমন ব্যবস্থা স্থির অনেক স্মার্ত্তের হয় না, বিচার প্রণালীও অতি তীক্ষ্ণবুদ্ধিশালীর ন্যায় ছিল। এক সময় সাতক্ষীরায় জমীদার প্রাণনাথ চৌধুরীর মৃত্যুতে তাঁহার দত্তক ও ঔরস পৌত্রের মধ্যে শ্রাদ্ধাধিকার লইয়া একটা বিষম গণ্ডগোল হয়। সভায় নানাস্থানের পণ্ডিত সমবেত হইয়া এক প্রবল বিচার হয়, বিচারে শিরোমণি মহাশয়েরই জয় হয়। তিনি ঔরস পৌত্রেরই শ্রাদ্ধাধিকার সাব্যস্ত করিয়াছিলেন।
  41. উমেশচন্দ্র বিদ্যারত্ন

  42. মৃত্যুঞ্জয়ের পুত্র। এমন অধ্যবসায়ী পুরুষ ভাটপাড়ায় অল্পই জন্মগ্রহণ করিয়াছিল। সংস্কৃতে ব্যুৎপন্ন হইয়া ইনি ইংরাজী বি.এ. পর্য্যন্ত অধ্যয়ন করেন। নিজের বিদ্যার্জনে যেমন অধ্যবসায়, দেশ হিতকর সাধারণ কার্য্যেও তেমনি উদ্যম ছিল। ইনি মিউনিসিপ্যালিটির কমিশনর হইয়া গ্রামের রাস্তাঘাটের অনেক শ্রীবৃদ্ধি করিয়া গিয়াছেন। ইনি গুরুতার সহিত হুগলি কলিজিয়েট স্কুলের প্রধান সংস্কৃত্যধ্যাপক হইয়া সম্ভ্রমের সহিত কাল কাটাইয়া গিয়াছেন। মধ্য বয়সে ইঁহার গঙ্গালাভ হয়। এখানে একটি কালচক্রের পরিবর্ত্তনের কথা না বলিয়া থাকা গেল না। ইঁহারই পিতামহের আমলে চাকরী ক্ষোভের বিষয় হইয়াছিল, ইঁহার আমলে সম্ভ্রমের। ধন্য কাল, তুমিই একমাত্র জীবের নিয়ন্তা।
  43. প্রফুল্লচন্দ্র ঠাকুর

  44. উমেশচন্দ্রের জ্যেষ্ঠপুত্র। একজন নির্বিরোধী শান্তশিষ্ট সদাচারী পুরুষ ছিলেন। ইনিও ইংরাজী বি.এ. পর্য্যন্ত অধ্যয়ন করিয়া বৎসরকয়েক নেপালের অন্তর্গত পাল্পা গবর্ণরের কুমারগণের গৃহশিক্ষকতা করিয়া যশস্বী হইয়াছিলেন। শেষে ই.আই. রেলওয়ের একজন বিশিষ্ট কর্ম্মচারী থাকেন। চাকরীর সহিত সদাচার থাকায় গুরুতাকার্য্য অব্যাহতই ছিল। মধ্য বয়সে ইঁহারও গঙ্গালাভ হয়। ইঁহার ধারা দৌহিত্রগত হইয়াছে।
  45. বিষ্ণুচন্দ্র বিদ্যারত্ন

  46. নিমাইচন্দ্রের কনিষ্ঠ পুত্র। বড় শান্তপ্রকৃতি সদাচারী ছিলেন। পুত্রে ইঁহার পুণ্য প্রকাশ।
  47. নীলমণি ঠাকুর

  48. রামমাণিক্যের ৪র্থ পুত্র। বংশোচিত মর্য্যাদাসম্পন্ন ও সংস্কৃতে বিশেষ ব্যুৎপন্ন ছিলেন।
  49. রামনিবারণ ঠাকুর

  50. নীলমণি ঠাকুরের পুত্র। ইনি একজন শান্তশিষ্ট সদাচারী ও দেশপর্য্যটক ছিলেন।
  51. জানকীনাথ ঠাকুর

  52. রামমাণিক্যের কনিষ্ঠ পুত্র। বংশোচিত মর্য্যাদাসম্পন্ন ও সংস্কৃতে বিশেষ ব্যুৎপন্ন ছিলেন। ব্যাকরণের ভাষ্যটীকা প্রভৃতি ইঁহার কণ্ঠস্থ ছিল। বড় সরল প্রকৃতির লোক ছিলেন অথচ এমন তেজস্বী ছিলেন যে কাহার কোন অন্যায় সহ্য করিতে পারিতেননা, মুখের উপরই তাহার প্রতিবাদ করিতেন। লোকে তাঁহাকে বড়ই সম্ভ্রম করিত।
  53. আনন্দরাম সিদ্ধান্ত

  54. সদাশিব ন্যায়ভূষণের কনিষ্ঠ পুত্র। পিতার উপযুক্ত পুত্র, মর্য্যাদার আকর ও বংশের গৌরব ছিলেন।
  55. রামচন্দ্র ঠাকুর

  56. আনন্দরামের জ্যেষ্ঠ পুত্র। বংশোচিত মর্য্যাদাসম্পন্ন ছিলেন।
  57. রঘুরাম ঠাকুর

  58. রামচন্দ্র ঠাকুরের কনিষ্ঠ পুত্র। বংশোচিতমর্য্যাদার সহিত তেজস্বীতা সহকারে কাটাইয়া গিয়াছেন।
  59. ক্ষেত্রনাথ ঠাকুর

  60. রঘুরাম ঠাকুরের পুত্র। শান্ত প্রকৃতি ও মিষ্টভাষী ছিলেন।
  61. ভৈরবচন্দ্র বিদ্যাসাগর

  62. আনন্দরামের কনিষ্ঠ পুত্র। ইনি একজন প্রাতঃস্মরণীয় মহাপুরুষ ছিলেন। অদ্বিতীয় নৈয়ায়িক, বহু ছাত্রের অধ্যাপক ও অন্নদাতা। ভাটপাড়া ইঁহার দ্বারা গৌরবান্বিত ছিল। যেমন দার্শনিক তেমনি আবার কাব্যালঙ্কাররসিক। তাঁহার নৈষধ ব্যাখ্যা হর্ষ বিস্ময়কারক হইত। আচারানুষ্ঠানই বা কি বিশুদ্ধ, যেন সাক্ষাৎ ঋষি। বহুদিন অধ্যাপনা করিয়া শেষ বয়সে কাশীবাসী হইবার কল্পনায় অধ্যাপনা ত্যাগ করেন। এমনি খাঁটি লোক যে যেমন অধ্যাপনা ত্যাগ অমনি নিমন্ত্রণপত্রগ্রহণ ত্যাগ৷ আসিলেও লইতেন না। মহিষাদলের রাজবাটী হইতে এই অবস্থায় এক পত্র আসে, উহাও প্রত্যাখ্যাত হইল। শিষ্যের প্রতিগ্রহ প্রতিগ্রহ নহে, উহা পুত্রের অর্থ। চাতরার এক মন্ত্রশিষ্য সাহায্য করিতে থাকিলেন, তিনি কাশীবাসী হইলেন। অগ্নি কি লুকাইয়া থাকিতে পারে, কাশীতেও সখের অধ্যাপনা চলিতে থাকিল; সখের অর্থাৎ শিষ্যব্যতীত অপরের প্রতিগ্রহশূন্য সে অধ্যাপনা। ছাত্রে শুনেনা, নানাদেশীয়, দ্রাবিড়াদি পর্য্যন্ত ছাত্রেরা বিদ্যার সাগরের কাছে আসিয়া মস্তক নত করিল, যাহার যেমন শক্তি সে তেমনি রত্ন সংগ্রহ করিয়া লইল। বাঙ্গালা দেশের মুখ উজ্জ্বল হইল। তাহার পর চাতরার সে শিষ্য হঠাৎ মর্ত্ত্যধাম ত্যাগ করিলেন। ভৈরবচন্দ্রের নিকট সে সংবাদ পৌঁছিল। আকুলনয়নে ভৈরব বিশ্বেশ্বরকে জানাইলেন। বিশ্বেশ্বর কি তাঁহার নিজের ভৈরবকে ছাড়িতে পারেন। অমনি তাঁহাকে কোলে টানিলেন। সেই রাত্রেই বিসূচিকা আর প্রাতেই শিবসারূপ্য। আবার এক অদ্ভূত ঘটনা। এ মহাত্মা পুত্রহীন, জ্ঞাতি বন্ধুও নিকটে কেহ নাই, ভৌতিক দেহের তো একটা শাস্ত্রসম্মত উপায় চই, বিশ্বেশ্বরের সেদিকেও তীক্ষ দৃষ্টি, যেমন অন্তিমকাল সন্নিহিত অমনি হঠাৎ কোথা হইতে তাঁহার দুইজন সপিণ্ড জ্ঞাতি পৌত্র ঠাকুরদাদা বলিয়া তাঁহার নিকট উপস্থিত। সব সুচারুরূপে সম্পন্ন হইয়া গেল। কি চমৎকার! এ ঘটনা পড়িলে মনে হয় কিসের ভাবনা জীব! কাহারও আবশ্যকতা নাই, নিয়ত ভাব সেই শিব যিনি সর্ব্বতঃ পাণিপাদ সর্ব্বতোহক্ষিশিরোমুখ সর্বতঃ শ্রুতিমৎ আর সর্ব্বমাবৃত্য তিষ্ঠতি ভাব, তাঁহাকে অনায়াসে তরিয়া যাইবে। হে মহাপ্রাণ ভৈরবচন্দ্র, কি তন্ময়তাই দেখাইয়া গিয়াছ! তোমায় নমস্কার! স্বর্গ হইতে এ বংশকে আশীর্ব্বাদ করিও।